Friday, November 9, 2012

বর দাও মধুকবি - বর দাও অকিঞ্চনে - ১

না পারি লোভ সম্বরিতে, দেখে তোমার মধুর ভান্ডার, হে মধুকবি!
তাইতো হুবহু করি সিঞ্চন, তোমার অমর মণি-মানিক্য-রতন!

"সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি পদে,
পাঠাইলা রণে পুণ: রক্ষকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিত মেঘনাদে - অজেয় জগতে -
ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নি:শঙ্কিলা?

বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি
আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি। যেমতি, মাত:, বসিলা আসিয়া,
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)
যবে খরতর শরে, গহন কাননে,
ক্রৌঞ্চবধু সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,
তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।
কে জানে মহিমা তব এ ভব মন্ডলে?

নরাধম আছিল যে নর নরকুলে
চৌর্য্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে,
মৃত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি!
হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর
কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে,
সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে!
হায়, মা, এ হেন পূণ্য আছে কি দাসে?

কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে
মূঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি
সমধিক। ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি
বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি,
মহাগীত, ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া।

-- তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী
কল্পনা! কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু
লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।
।।।।।।।।।।
।।।।।।।।।।
।।।।।।।।।।

নামি আমি, কবি-গুরু, তব পদাম্বুজে,
বাল্মীকি! হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি,
তব অনুগামী দাস, রাজেন্দ্র-সঙ্গমে
দীন যথা যায় দূর তীর্থ-দরশনে!
তব পদ-চিহ্ন ধ্যান করি দিবা নিশি,
পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে,

দমনিয়া ভব-দম দূরন্ত শমনে -
অমর! শ্রীভত্তৃহরি; সূরী ভবভূতি
শ্রীকন্ঠ, ভারতে খ্যাত বরপুত্র যিনি
ভারতির, কালিদাস - সুমধুর-ভাষী;
মুরারী-মুরলী-ধ্বনি-সদৃশ মুরারি
মনোহর; কীর্ত্তিবাস, কীর্ত্তিবাস কবি,
এ বঙ্গের অলঙ্কার! - হে পিত:, কেমনে,

কবিতা-রসের সরে রাজহংস-কুলে
মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি?
গাঁথিব নতুন মালা, তুলি সযতনে
তব কাব্যোদ্যানে ফুল; কিন্তু কোথা পাব
(দীন আমি!) রত্নরাজী, তুমি নাহি দিলে,
রত্নাকর? কৃপা, প্রভু, কর অকিঞ্চনে! ---"

আজ প্রায় দুশো বছর পরেও কি উজ্জ্বল তুমি - হে মধুকবি, এ বঙ্গের অলঙ্কার!
তোমার অমরতার তীব্র আকুতির সত্য পরিণতি - কবি, আজ যশের মন্দিরের সমস্ত চূড়ায় চূড়ায়!
তোমার প্রার্থনার মঞ্জুরি ঘোষনা করেছেন বাংলা কবিতার সব অমর দেবতারা!
বাংলা-কবিতা-রসের রাজ সরোবরে কি অপূর্ব বিরাজিত রাজহংস তুমি, দত্ত-কূলোদ্ভব-কবি-শ্রী-মধুসূদন!
কতো যে নতুন মালা গেঁথেছ তুমি বাংলা কবিতায়, আদি-রত্নাকরে পরাজিত করি, হে নব্য-রত্নাকর!
কতো যে বাঙ্গালীর হৃদয় কেঁদেছে তোমার কবিতার জন্য জীবন বিসর্জনে!
এই অতি অক্ষমের হৃদয় মন্দিরে দেবতার আসনে আজো তুমি আছো কবি, সেই সে কৈশোরের উদ্বোধনের দিন হতে শুরু করে - আজও!
আজও এই অকিঞ্চনের চোখের ধারায় কবিতা-কাঞ্চনের অবিনাশী আকুতি - হেরো হে কবি-সম্রাট!
গুরু কবি রবি ঠাকুরের সর্বগ্রাসী কবিতা-মোহতার পরেও, প্রেমী-বিদ্রোহী কবি নজরুলের গানের অপূর্ব ঝংকারের পরেও, শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দের অবিনাশী আধুনিকতার পরেও, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিশ্রমী বিশুদ্ধ কবিতার পরেও, শক্তি, সুনীল, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, জয় গোস্বামী, আরও আরও কীর্তিমান বাংলা কবিতা-স্রষ্টাদের পরেও তুমি অনন্য, তুমি প্রাসঙ্গিক, তুমি আজও আধুনিক - কবিতার বর-পুত্র হে মধুসূদন!!
আর তাই -- বর চাই, বর চাই, হে পিত:, কবিতা-রসের রাজসরোবরে রাজহংস-কুলে কি সাহসে খেলা করি আমি, না শিখালে তুমি? ভাবি আমি - তোমার উদ্যমের ফুলগুলো দিয়ে নতুন নতুন মালা,
যদি গেঁথে দিতে পারি কালের পরম্পরায়! তোমার কাব্যোদ্যানের কতশত ফুল! কিন্তু কোথা পাব (দীন আমি!) শত ফুল, আর উত্তর-উত্তর-আধুনিকতার শত-শত-মণি-কাঞ্চন?

তুমি যদি না দাও, বাংলা কবিতার প্রথম বিপ্লবী-ঈশ্বর?

আজ কৃপা তাই, করো মোরে প্রভু, কর কৃপা এই অকিঞ্চনে!